
ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী “বড় মসজিদ” দেশের লোকমুখে দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত। স্থানীয় ইতিহাস ও সংবাদসংকলন অনুযায়ী মসজিদটি শুরুটা পেয়েছিল উন্মুক্ত প্রার্থনা-স্থান ও টিনের ছাপড়া থেকে—শৈশবেই তা ক্রমে স্থায়ী নির্মাণে রূপ নেয় এবং এরপর থেকে বারবার সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে। মসজিদের বর্তমান পুরাতন অংশটির বয়সকে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদ সাময়িকী প্রায় ১৭৫ বছরেরও বেশি হিসেবে বর্ণনা করেছে।
১৯৩৫ সালে মসজিদটি “Mussalman Wakf Validating Act, 1913”-এর আওতায় ওয়াকফ হিসেবে নথিভূক্ত হয় এবং এরপর থেকে একধরনের পাবলিক-ওয়াকফ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে — যার ফলে মসজিদ-মাদ্রাসার জমি ও ব্যবহার আইনীভাবে সুরক্ষিত হয়েছে।

বড় মসজিদের স্থাপত্য স্থানীয় ও বিদেশি কারিগরত্বের মিশ্রণ দেখায় — দেয়ালজুড়া মোজাইক টাইল, সজ্জিত গম্বুজ, ঝাড়বাতি ও আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমসহ অভ্যন্তর সাজসজ্জার খ্যাতি রয়েছে। মসজিদ প্রাঙ্গণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল—এটির বিশালতা: মসজিদটি প্রায় ১.৯ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং বড়-ঈদের সময় ৫ হাজারের কাছাকাছি মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয় বলে স্থানীয় সংবাদে বর্ণিত. এছাড়া মসজিদের মিনার-গম্বুজ ও বাহ্যিক নকশাও দর্শনীয়ভাবে সংরক্ষিত আছে।
মাদ্রাসা ও শিক্ষা কার্যক্রম — হিফজি-ময়দান থেকে উচ্চতর পাঠক্রম পর্যন্ত
মসজিদের সংলগ্ন বা মসজিদকেন্দ্রিক একটি তিনতলা হিফজি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে — সংবাদ সূত্রের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এখানে প্রায় ১,২০০ জন ছাত্র দ্বীনি শিক্ষা (বিশেষত হিফজ) করছেন। তিনতলা হিফজি কাঠামোতে হোস্টেল/ছাত্রাবাস, শ্রেণিকক্ষ ও পঠনের উপযোগী পরিবেশ রাখা আছে। উচ্চতর স্তরে হাদিস, তাফসীর ও ফিকহের উপর পাঠক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা স্থানীয় প্রকাশনায় বলা হয়েছে; তবে নির্দিষ্ট পাঠক্রম-ঘণ্টা/বিষয়ের তালিকা অফিসিয়াল রেকর্ড না দেখলে অবশ্য নির্দিষ্টভাবে দাঁড় করানো যাবে না।
মাদ্রাসার সামাজিক অবদানও উল্লেখযোগ্য: গরিব ও অনাহারে পড়ুয়া অনেক ছাত্র এখানে বৃত্তি বা খাবার-সহায়তা পেয়ে লেখাপড়া চালান—এটি ঐতিহ্যবাহী ওয়াকফ-ভিত্তিক মাদ্রাসার সাধারণ দিক।
স্থানীয় ইতিহাস ও সংবাদে মাওলানা সৈয়দ ফয়জুর রহমান (১৮৯৪–১৯৯৭)-এর নাম খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসে। তিনি দীর্ঘ সময় (রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৪১–১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, প্রায় ৫৬ বছর) এখানে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেছেন — তার আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সেবা মসজিদ-মাদ্রাসার খ্যাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মাওলানার সময়কাল ও কাজের কারণে মসজিদটি শুধু স্থাপত্যগত ঐতিহ্যই নয়, আধ্যাত্মিক শিক্ষারও কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহাসিক বড় মসজিদ-মাদ্রাসা শুধু একটি উপাসনালয় নয়; এটি একটি সক্রিয় ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রায় দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই মসজিদ-মাদ্রাসা দ্বীনি শিক্ষা, ইমামত, সামাজিক সেবা ও দাওয়াহ কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেছে।
মসজিদের সঙ্গে যুক্ত জামিয়া ফয়জুর রহমান (রহ.) মাদ্রাসা বর্তমানে একটি পূর্ণাঙ্গ হিফজি ও কিতাব বিভাগে পরিণত হয়েছে। Dhaka Tribune-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১,২০০ জন শিক্ষার্থী এখানে কুরআন হিফজ, তাজবিদ, ফিকহ, হাদীস, আরবি ভাষা ও ইসলামী চিন্তাধারার ওপর শিক্ষা গ্রহণ করছে। ছাত্ররা দুই পর্যায়ে শিক্ষা পায় — (১) হিফজুল কুরআন বিভাগ, যেখানে কুরআন মুখস্থ করা হয়, এবং (২) দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত কিতাব বিভাগ, যেখানে ইসলামি শরিয়াহ-সংক্রান্ত উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করা যায়।
মাদ্রাসাটির শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ওয়াকফ ভিত্তিক, অর্থাৎ সমাজের দান-অনুদানের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিনা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়; অনেকের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বিনামূল্যে রাখা হয়েছে। ছাত্রাবাসটি মসজিদ-সংলগ্ন তিনতলা ভবনে অবস্থিত, যেখানে প্রায় ৫০০ জন আবাসিক শিক্ষার্থী থাকে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদান ছাড়াও মাদ্রাসায় প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত, হাদীস পাঠ, দুআ মাহফিল ও মাসিক ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। রমজান মাসে তারাবিহ, ইতিকাফ ও ইফতার আয়োজনসহ বৃহৎ পরিসরের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহায় শহরের অন্যতম বৃহৎ জামাত এখানে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করেন।
মাদ্রাসার প্রশাসন নিয়মিতভাবে এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে; ধর্মীয় পরামর্শ, কবরস্থান পরিচালনা, সামাজিক সমস্যা-সমাধান ও মানবিক সাহায্যেও তারা অংশ নেয়। মাদ্রাসার তত্ত্বাবধানে কিছু দাতব্য প্রকল্প চালু আছে — যেমন দরিদ্র শিক্ষার্থীর চিকিৎসা সহায়তা, পোশাক বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ ও কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে শিক্ষা-তহবিলে যুক্ত করা।
এছাড়াও, তরুণ প্রজন্মকে ইসলামি আদর্শে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাদ্রাসায় আখলাক (নৈতিক শিক্ষা), তাফসীর ক্লাস, এবং মাঝে মাঝে জনসচেতনতামূলক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষক, ইমাম ও সমাজকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, পাঠক্রম আধুনিকীকরণ এবং সাধারণ শিক্ষার (বাংলা-ইংরেজি-গণিত) সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ নিচ্ছে। তাদের লক্ষ্য—একটি আদর্শ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো।
বড় মসজিদ-মাদ্রাসা আজ ময়মনসিংহের ধর্মীয় ও শিক্ষাগত পরিচয়ের প্রতীক। কুরআন-হাদীস শিক্ষা, সামাজিক দাওয়াহ, ও মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষার সংযোজন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং সমাজের সার্বিক সহযোগিতা।
জামিয়া ফয়জুর রহমান (রহ) বড় মসজিদ মোমেনশাহী